চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজজট কমতে শুরু করেছে

জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য সপ্তাহখানেক অপেক্ষায় থাকা যেন নিয়মে দাঁড়িয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। তাতে জাহাজ আসার পরও পণ্য হাতে পেতে ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা করতে হতো। গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই অপেক্ষার সময় এখন কমতে শুরু করেছে।
গত মঙ্গলবার বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থ বা জিসিবে ক্রেনযুক্ত যে দুটি কনটেইনার জাহাজ ভিড়েছে, সেগুলো বন্দর জলসীমায় আসার দুই-এক দিন পরই জেটিতে ভেড়ানো হয়েছে। তবে ক্রেনবিহীন জাহাজের অপেক্ষার সময় এখন ৭ থেকে ১০ দিনের বদলে ৪ দিনে নেমে এসেছে। আবার জেটিতে ভেড়ানোর জন্য সাগরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা ১৪–১৫ থেকে ৬–এ নেমেছে।
রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার কাঁচামাল আমদানি হয় কনটেইনারে। ফলে পণ্য হাতে পেতে দেরি হলে এসব কারখানার পণ্য উৎপাদনে বাড়তি সময় লাগে। আবার রপ্তানির পুরোটাই পরিবহন করা হয় কনটেইনারে। প্রায় ছয় মাস ধরে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করলেও এখন পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কিছুটা স্বস্তিতে আছেন উদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ও বিজিএমইএর পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ‘বন্দরে জাহাজজটের কারণে অনেক দিন ভুগতে হয়েছে উৎপাদনমুখী খাতের উদ্যোক্তাদের। এখন জট কমে আসায় কিছুটা স্বস্তি ফিরবে, তবে এটা ধরে রাখতে হবে। কারণ, জটের কারণে পণ্য হাতে পেতে দেরি হলে আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব।’
শিপিং এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের এ বছরের শুরুটা হয়েছিল জাহাজজট মুক্ত অবস্থায়। বছরের শুরুতে বন্দর জলসীমায় আসা জাহাজ দিনে দিনে জেটিতে ভেড়ানো যেত। বড়জোর অপেক্ষার সময় ছিল এক দিন, তবে ফেব্রুয়ারি মাসে তিন দিন পরিবহন ধর্মঘটে বন্দরে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো ও খালাসে ব্যাঘাত ঘটে। তাতে জাহাজের অপেক্ষা বাড়তে থাকে। এরপর স্বাভাবিক অবস্থায় আসার আগেই দুই ঈদে লম্বা ছুটি, আরও কয়েক দফায় পরিবহন ধর্মঘট এবং অর্থবছরের শেষ হওয়ার আগে জুনে এনবিআরের
আন্দোলন কর্মসূচির কারণে জাহাজজট দীর্ঘায়িত হয়।
জাহাজজটের মধ্যে কনটেইনার পণ্য পরিবহনের চাপও বাড়তে থাকে। তাতে জাহাজজটে ঘুরপাক খেতে থাকে বন্দর। এতে এ সময় কোনো কোনো দিন একসঙ্গে ২০ থেকে ২৪টি জাহাজকে জেটিতে ভেড়ানোর জন্য সাগরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রায় ছয় মাস ধরে চলা এই অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে। গত মঙ্গলবার জেটিতে ভেড়ানোর অপেক্ষায় ছিল ছয়টি কনটেইনার জাহাজ।
জানতে চাইলে শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, জেটিতে কনটেইনার জাহাজ আগের তুলনায় বেশি ভেড়ানো এবং টার্মিনালগুলোতে কাজের গতি বাড়ার কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেডের পরিচালনায় থাকা নিউমুরিং টার্মিনালে আগের তুলনায় কাজের গতি বেড়েছে, যা বন্দরে জট কমাতে ভূমিকা রেখেছে।
শিপিং এজেন্টরা জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে নতুন করে চাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে নতুন ক্রয়াদেশ আসছে। আবার স্থলবন্দর দিয়ে কয়েকটি খাতের পণ্য রপ্তানিতে ভারত বিধিনিষেধ দিয়েছে। তাতে ভারতমুখী রপ্তানি পণ্যের বড় একটা অংশ এখন সমুদ্রবন্দর দিয়ে রপ্তানি হচ্ছে। গত জুলাই মাসে বন্দর দিয়ে ৮৬ হাজার কনটেইনার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই সংখ্যা ৩৮ শতাংশ বেশি। আবার পণ্যবাহী কনটেইনার আমদানি হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার একক, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ গত জুলাইয়ে বন্দর পথে চলাচল করা জাহাজের সংখ্যা কমানোর পদক্ষেপ থেকে এখনো সরে আসেনি বলে জানিয়েছে শিপিং এজেন্টসরা। জুলাই মাসে তীব্র জাহাজজটের কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বন্দর রুট থেকে অন্তত ১৫টি জাহাজ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। শিপিং এজেন্টসরা এই উদ্যোগে সায় দেয়নি। এখন আবারও জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোকে ডেকে জাহাজ কমানোর কথা বলছে কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে কনটেইনার জাহাজ পরিচালনাকারী জিবিএক্স লজিস্টিকস লিমিটেডের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব অপারেশন মুনতাসীর রুবাইয়াত বলেন, বন্দরে এখন আগের মতো জাহাজজট নেই। পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। অন্যদিকে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরের মতো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে অনেক কনটেইনার পড়ে আছে। দেশ থেকে পণ্য রপ্তানিও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জাহাজের সংখ্যা কমানো হলে পণ্য পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যেতে পারে।
বন্দরের পদক্ষেপ নিয়ে জানতে চাইলে বন্দরসচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, জেটিতে কনটেইনার জাহাজের সংখ্যা আগের তুলনায় বেশি ভেড়ানো হচ্ছে। কনটেইনার ধারণক্ষমতাও বেড়েছে। তাতে জাহাজজট কমেছে। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় জাহাজের সংখ্যা কমানো হবে কি–না তা নির্ভর করছে এ সংক্রান্ত কমিটির প্রতিবেদনের ওপর।