শ্রম আইন সংশোধন- ২০ জন শ্রমিকেই ট্রেড ইউনিয়ন সহ আরো নীতিমালার পরিবর্তন

শ্রম আইন সংশোধন করে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন আরও সহজ করা হচ্ছে। বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি লাগে। সংশোধিত আইনে ‘শতাংশ’ আর রাখা হচ্ছে না। অনেক তর্কবিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত মালিক, শ্রমিক ও সরকার—তিন পক্ষই এ বিষয়ে একমত হয়েছে।
শ্রমিকপক্ষ বলেছে, ন্যূনতম ২০ জন শ্রমিকের সায় থাকলেই যেন কোনো কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করা যায়। মালিকপক্ষও শতাংশের বদলে সংখ্যার ব্যাপারে রাজি। তবে পোশাক কারখানা ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ২০ থেকে আরও বেশি হোক, এটা চায় মালিকপক্ষ।
৬০ সদস্যের ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) ৮৯তম বৈঠকে এসব আলোচনা হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে দিনব্যাপী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। টিসিসিতে সরকার, মালিক ও শ্রমিক—তিন পক্ষে ২০ জন করে সদস্য রয়েছেন।
শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়-সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, টিসিসির সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শ্রম উপদেষ্টা পুরো সময় ছিলেন না। টিসিসির প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এবং কানাডীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারা ছিলেন পর্যবেক্ষক হিসেবে।
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, শ্রমিক ও মালিক পক্ষের পরামর্শের ভিত্তিতে শ্রম আইন যুগোপযোগী করা হবে। এটি হবে বাংলাদেশের শ্রমখাতের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ; সঙ্গতিপূর্ণ হবে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে।
কারখানা বড় হলে শ্রম আইন অনুযায়ী বর্তমানে তিনটি ট্রেড ইউনিয়ন করার বিধান রয়েছে। এখন পাঁচটি ইউনিয়ন করা হবে। শ্রমিকপক্ষ বলেছে, ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা একাধিক হলে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন করা হবে যৌথ দর-কষাকষি প্রতিনিধিদল বা সিবিএ। শ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি এখন বৃদ্ধি পায় পাঁচ বছর পরপর। আইন সংশোধন করে তা তিন বছর করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে তিন পক্ষই একমত হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বৈঠকে বলেন, ‘একটি পক্ষ চায়, শ্রম আইন সংশোধনের কাজটা পিছিয়ে যাক। পরের সরকার এসে করুক। যদি ধরে নিই, আগামী ফেব্রুয়ারির তিন মাস আগে মানুষ নির্বাচনের আমেজে থাকবেন, তাহলে আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। বলা যায় ৫৫ কার্যদিবস সময় আছে। শ্রম আইন সংশোধন কাজের বাকি প্রক্রিয়া তাই কাল থেকেই শুরু করতে হবে।’
শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, সেপ্টেম্বরজুড়ে এ নিয়ে কাজ হবে। আর অক্টোবরের মধ্যে আইন সংশোধন হয়ে যাবে।
১০০ স্থায়ী শ্রমিক থাকলে ভবিষ্য তহবিল
বর্তমান আইনে আছে, কোনো প্রতিষ্ঠান তার শ্রমিকদের সুবিধার জন্য ভবিষ্য তহবিল গঠন করবে। এখন বলা হচ্ছে, ১০০ স্থায়ী শ্রমিক থাকলেই মালিকপক্ষ ভবিষ্য তহবিল গঠন করতে বাধ্য থাকবে। শিশুশ্রমের জন্য নিয়োগকর্তাকে জরিমানার পরিমাণ ৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হবে।
নতুন একটি ধারা যুক্ত করে বলা হচ্ছে, কোনো শ্রমিক যদি নিয়োগকর্তাকে জানান যে তাঁর জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের বিপদ আছে, তাহলে নিয়োগকর্তা সেই বিপজ্জনক কাজ করাতে বাধ্য করতে পারবেন না। শ্রমিকেরা যদি আইন ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতির বিধান অনুযায়ী কোনো সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেন, তাহলে নিয়োগকর্তা তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। এ ছাড়া শ্রমিকদের কালোতালিকা আর করা যাবে না।
মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করা এবং দুর্ঘটনায় হতাহতের জন্য ক্ষতিপূরণ বাড়ানোর দাবি মালিকপক্ষ মেনে নেয়নি।
আলোচনায় অন্যান্য বিষয়
বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, মালিক অন্যায় করলে শাস্তি পাক। কিন্তু যখন-তখন শ্রমিকেরা যে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের লোকদের মারধর করেন, উৎপাদন ব্যাহত করেন, তার বিধান কী? জবাবে শ্রমসচিব বলেন, এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলা হবে।
মাতৃত্বকালীন ছুটি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে টিসিসি সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন বৈঠকে বলেন, আইন লঙ্ঘনে শাস্তি যেন শাস্তির মতো হয়।
টিসিসির আরেক সদস্য বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সাকিল আখতার চৌধুরী বৈঠকে বলেন, কর্মক্ষেত্রে শ্রম আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার জন্য আইনে সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তির বিধান রাখতে হবে।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বৈঠকে বলেন, কোনো কারখানায় অনেক শ্রমিক মারা গেলেও মালিকদের শাস্তি ওই চার বছর জেল। এর সংশোধন দরকার।
বৈঠক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো বৈঠক হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন যে আর শতাংশে হবে না, এটা নিশ্চিত। তবে ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে আরও কিছু কাজ করবে মন্ত্রণালয়। কয়েক দিন পরই সব চূড়ান্ত হয়ে যাবে।