বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে অন্তর্কোন্দল- এমডির পদত্যাগ, চেয়ারম্যানের অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগ

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে অন্তর্কোন্দল- এমডির পদত্যাগ, চেয়ারম্যানের অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগ

নানা অনিয়মের জালে আটকা পড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক দীর্ঘদিন আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। ব্যাংকটিকে ভালো অবস্থায় নিতে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নতুন পর্ষদ ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করছে। বিশেষত ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাহী চেয়ারম্যান ব্যাংকের নিয়মিত ঋণ কার্যক্রম, নিয়োগ, বদলি, শাস্তিসবকিছুতেই হস্তক্ষেপ করছেন। তারা ব্যাংকের কর্মীদের মতো প্রতিদিন অফিস করছেন এবং সব কাজেই নির্দেশনা দিচ্ছেন। ব্যাংকের এমডি এসব নিয়ে আপত্তি করলে ইতোমধ্যে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। 

সরকার পরিবর্তনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে কমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই সাবেক নির্বাহী পরিচালক আতাউর রহমানকে চেয়ারম্যান এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মহসিন মিয়াকে নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান করে পাঁচ সদস্যের পর্ষদ গঠন করা হয়। নতুন পর্ষদে শেখ আশ্বাফুজ্জামান এফসিএকে অডিট কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। বাকি দুই সদস্য আগে থেকেই ছিলেন। আতাউর রহমান কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অবসরের পর ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সমস্যাগ্রস্ত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রধান ছিলেন। আর মহসিন মিয়া ছিলেন সুরুজ মিয়া স্পিনিং মিলের উপদেষ্টা। এই স্পিনিং মিলের সুদ মওকুফ কিছু নিয়োগকে কেন্দ্র করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন গত ৩০ জুলাই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। 

গত ৩০ জুলাই৪৮ কোটি টাকার সুদ মওকুফ: পদত্যাগ করলেন বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের এমডিশিরোনামে অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।  প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তদন্ত কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত থেকে আগস্ট ব্যাংকটিতে সরেজমিন পরিদর্শন, পরিচালনা পর্ষদ বৈঠকের অডিও যাচাই এবং সব পক্ষের বক্তব্য নিয়ে দৈনন্দিন কাজে পর্ষদের হস্তক্ষেপ এমডিকে  পদত্যাগে বাধ্য করার সত্যতা পেয়েছে পরিদর্শক দল। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিদর্শক দল সুপারিশ করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, কমার্স ব্যাংকের এমডিকে ডেকে প্রথমে বক্তব্য নেওয়া হবে। এর পর পরিচালনা পর্ষদ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এর আগে গত ৩১ জুলাই মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে -সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর . আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে এসেছে। পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল ব্যাংকের দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনায় পর্ষদের হস্তক্ষেপের সরাসরি প্রমাণ পেয়েছে। যে কারণে চেয়ারম্যান নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানকে জনস্বার্থে দায়িত্ব থেকে বিরত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। সাময়িকভাবে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেছে পরিদর্শক দল। ছাড়া এমডির পদত্যাগপত্র নামঞ্জুর করে তাঁকে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশের সুপারিশ করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথ্য পেয়েছে, ঋণ আদায় সুদ মওকুফে পর্ষদ সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। ব্যাংকের নিয়োগ, বদলি, শাস্তিসব সিদ্ধান্তই দিচ্ছেন চেয়ারম্যান নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান। এমডি এবং অন্যান্য কর্মকর্তাকে প্রায়ই নিজেদের কক্ষে ডেকে বিভিন্ন অযাচিত বিধিবহির্ভূত নির্দেশনা দেন। তাদের নির্দেশনা না শুনলে অশালীন ভাষায় গালাগাল করেন।

কমার্স ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, মোশাররফ হোসেন ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগদান করেন গত ১৬ জানুয়ারি। পদত্যাগ করেন ৩০ জুলাই। সময়ে মোট কর্মদিবস ছিল ১২৬ দিন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান ১১৩ দিন এবং নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ১০৮ দিন অফিস করেছেন। দুজনই সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অফিসে থাকেন। তারা বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের রুমে ডেকে নিয়ে নানা নির্দেশনা দেন। এমডিকে শাখা পরিদর্শনে নিরুৎসাহিত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুষ্ঠানে যেতে নিষেধ করেন।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে সব ব্যাংকের প্রধান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগদানের জন্য এমডির নামে রুম বুকিং টিকিট নিশ্চিত করা হয়। চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় শেষ সময়ে তা বাতিল করতে হয়েছে। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে এমডি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা না বললে নানাভাবে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করেছেন। এমনকি খেলাপি ঋণের মামলা পরিচালনা হচ্ছে চেয়ারম্যানের পছন্দমতো আইনজীবী দিয়ে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তীব্র তারল্য সংকটে চলছে কমার্স ব্যাংক। এর মধ্যে ব্যাংকের ভেতরে চেয়ারম্যানের চেম্বারের পাশে প্রায় লাখ টাকা খরচ করে আলাদা একটি শোবার ঘর বানানো হয়েছে।  বিষয়টি ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার পরিচয়। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মহসিন মিয়ার জন্য একটি চেম্বার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাঁকে সার্বক্ষণিক সহায়তার জন্য একজন পিএস এমএলএসএস দেওয়া হয়েছে।
 কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে নিয়মিত পুলের গাড়ি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

এমডি পদত্যাগে বাধ্য হন যেসব কারণে 
গত ২৯ জুলাই পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে সুরুজ মিয়া স্পিনিংয়ের ৮৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৪৮ কোটি টাকার সুদ মওকুফে আপত্তি করেন এমডি। চেয়ারম্যান এতে ক্ষেপে যান। ওই দিনের পর্ষদ বৈঠকের অডিও যাচাই করে দেখা গেছে, গ্রাহক কর্মকর্তাদের সঙ্গে চেয়ারম্যানের সরাসরি দেখা করা এবং আঞ্চলিক প্রধানদের সঙ্গে দৈনন্দিন কার্যক্রম সম্পাদনের বিরোধিতা করেন এমডি। এর পরই নতুন লোক নিয়োগ বিষয়ে এমডির অনীহার অভিযোগ তুলে চেয়ারম্যান তাঁকে ওই দিনই পদত্যাগ করাবেন বলে জানান। সময় আরেক পরিচালক গোলাম মরতুজা বলেন, সরাসরি পদত্যাগ করালে গভর্নরের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ দাঁড় করাতে হবে। আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি কামরুল হক মারুফ বলেন, ব্যাংকের আর্থিক সূচক উন্নয়নে তাঁকে থেকে মাস সময় দেওয়া উচিত। এর পর চেয়ারম্যান আতাউর রহমান এমডি মোশারফ হোসেনকে বলেন, ‘আজকেই পদত্যাগ করে অফিস ছাড়বেন।এমডি পরদিন পদত্যাগপত্র জমা দেন।

পদত্যাগকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশারফ হোসেন বলেন, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করছে। এখনও পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি। সুতরাং নিয়ে তাঁর  কথা বলা ঠিক হবে না।

চেয়ারম্যানের বক্তব্য 
ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, এটি ঠিক নয়। তিনি ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করেন। সুদ মওকুফ, নিয়োগ, বদলি, শাস্তি; সব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন কিনাজানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সুরুজ মিয়া স্পিনিংয়ের সুদ মওকুফ বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, কোম্পানিটি ৮৪ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে ৪০ কোটি টাকা দিতে চায়। পর্ষদ অনুমোদন না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে।

নিয়মিত অফিস করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই তথ্য ঠিক নয়। ১২৬ দিনের মধ্যে ১১৩ দিন অফিস করার রেকর্ড রয়েছে জানালে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, অফিস করতে অসুবিধা কোথায়? শোবার ঘরের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা শোবার ঘর নয়। পরিচালকদের বসার জন্য একটা রুম বানানো হয়েছে।তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাইরে থেকে বড় বড় পার্টি আসে। তাদের এই রুমে নিয়ে কথা বলি। তবে আমি একা কথা বলি না। কথা বলার সময় নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানকে ডাকি। একা কথা বললে বলবে, চেয়ারম্যান সাহেব নেগোসিয়েশন করে টাকা খাচ্ছেন।যে কারণে মহসিন সাহেবের জন্য একটা রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এমডিকে চাপ দিয়ে পদত্যাগ করানোর বিষয়ে বলেন, এটা ঠিক নয়। পারফরম্যান্স বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পদত্যাগ করেন।