পণ্য জীবাণুমুক্ত করার যন্ত্রের অপ্রতুলতা, বাধাগ্রস্ত রপ্তানি

পণ্য জীবাণুমুক্ত করার যন্ত্রের অপ্রতুলতা, বাধাগ্রস্ত রপ্তানি

পণ্য জীবাণুমুক্ত করার সেবা না পাওয়ায় মসলা, পশুখাদ্য ও নানা ধরনের চিকিৎসাসামগ্রীর রপ্তানি কমে গেছে। এসব পণ্য জীবাণুমুক্ত করে রপ্তানি করতে হয়। কিন্তু এ সেবা প্রদানকারী সরকারি একটি কেন্দ্র বন্ধ থাকায় পণ্য জীবাণুমুক্ত করার সেবা পেতে বিলম্ব হচ্ছে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর। এ কারণে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের এসব পণ্য রপ্তানি কমে অর্ধেক হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলোতে মসলা, পশুখাদ্য ও নানা চিকিৎসাসামগ্রী রপ্তানির আগে সেগুলো জীবাণুমুক্ত করতে হয়। করোনা মহামারির পর বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানিতে এ বিষয়ে কঠোর হয় উন্নত দেশগুলো। এসব পণ্য ও সামগ্রী জীবাণুমুক্ত করতে ব্যবহার করা হয় গামা তেজস্ক্রিয়তা (গামা রেডিয়েশন)। সাভারের পরমাণু শক্তি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের আওতাধীন ইনস্টিটিউট অব রেডিয়েশন অ্যান্ড পলিমার টেকনোলজিতে (আইআরপিটি) ২০০৯ সাল থেকে বাণিজ্যিক এ সেবা চালু করেছিল সরকার। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে এই কেন্দ্র। তাই বিকল্প হিসেবে ইনস্টিটিউট অব ফুড অ্যান্ড রেডিয়েশন বায়োলজি (আইএফআরবি) এ সেবা দিয়ে আসছে। কিন্তু আইআরপিটির চেয়ে আইএফআরবির সক্ষমতা কম। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের সেবা পেতে দেরি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে রপ্তানিতে। এতে মসলা, পশুখাদ্য রপ্তানিকারক কিছু প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি অর্ধেকের বেশি কমে গেছে।

বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মসলা ও মসলাজাতীয় পণ্য রপ্তানি করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। গ্রুপটির পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতি মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা ৮০০ থেকে ৯০০ টন মসলা রপ্তানি করি। যুক্তরাষ্ট্রে মাসে গড়ে ১০ টন মসলা রপ্তানির চাহিদা রয়েছে। কিন্তু জীবাণুমুক্ত করার সেবার অপ্রতুলতার কারণে এখন মাত্র ৫ টন মসলা রপ্তানি করতে পারছি যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের মসলা রপ্তানি অর্ধেক কমে গেছে পণ্য জীবাণুমুক্ত করার সেবা না পেয়ে।’

আমাদের চারপাশে নানা ধরনের তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে। মুঠোফোন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, এমনকি সূর্যও তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। সবচেয়ে শক্তিশালী তেজস্ক্রিয়তা হলো গামা তেজস্ক্রিয়তা। ‘কোবাল্ট-৬০’ আইসোটোপ থেকে নিঃসৃত গামা তেজস্ক্রিয়তা মানুষের ডিএনএ এবং আরএনএ নিমেষেই ভেঙে ফেলতে পারে। তাই এ পরমাণু শক্তি খাবারের মতো পণ্য জীবাণুমুক্ত করতে ব্যবহার করা হয়। ঢাকার সাভারের পরমাণু শক্তি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে ১৩টি ইনস্টিটিউট আছে। এর মধ্যে দুটি ইনস্টিটিউট (আইআরপিটি ও আইএফআরবি) পণ্য জীবাণুমুক্ত করার সেবা দিয়ে থাকে। তবে বাণিজ্যিকভাবে সেবা দেয় আইআরপিটি। আর আইএফআরবি এ-সংক্রান্ত গবেষণা করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে আইআরপিটি বন্ধ থাকায় সীমিত পরিসরে এ সেবা দিচ্ছে আইএফআরবি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আইআরপিটির কার্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নতুন একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ কারণে সাময়িকভাবে এ তেজস্ক্রিয়তা কেন্দ্রের বাণিজ্যিক সেবা বন্ধ রয়েছে। প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আইআরপিটির সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্পের মেয়াদ গত ৩০ জুন শেষ হয়েছে। মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফলে এটি চালু করাও সম্ভব হচ্ছে না।

জানতে চাইলে আইআরপিটি ও প্রকল্প পরিচালক রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব ধরনের যন্ত্রপাতি কেনা শেষ। এখন এসব যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের কাজ বাকি। শিগগিরই এ কাজ শেষ হবে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি। এরপর আবারও বাণিজ্যিক সেবা দেওয়া শুরু হবে।’

সেবা বন্ধে কমেছে রপ্তানি

সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে আইআরপিটি ২ লাখ ৪৬ হাজার কেজি মসলা তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেই পরিমাণ কমে ৯৬ হাজার কেজিতে নেমে আসে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১১ হাজার কেজিতে।

স্কয়ার ফুড ও বেভারেজের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ১৭২ টন মসলা তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করে রপ্তানি করেছে। ২০২২ সালে এ রপ্তানির পরিমাণ কমে ৪৯ টনে নেমে আসে। ২০২৩ সালের আইআরপিটির সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আইএফআরবি থেকে রপ্তানির মসলা জীবাণুমুক্ত করার সেবা নিচ্ছে স্কয়ার ফুড। তাতে গত বছর প্রতিষ্ঠানটির মসলা রপ্তানির পরিমাণ আরও কমে ১৪ টনে নেমে আসে। রপ্তানি কমে যাওয়ায় কমেছে রপ্তানি আয়ও।

স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা পারভেজ সাইফুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পণ্য জীবাণুমুক্ত করার সেবা পেতে বিলম্বের কারণে গত ফেব্রুয়ারি মাসের ক্রয়াদেশ এখনো পাঠাতে পারিনি। একটি কনটেইনারে ২৬ টন মসলা পাঠানো যায়। কিন্তু যথাসময়ে তেজস্ক্রিয়তা সেবা না পাওয়ায় এক কনটেইনারে ১৩ টন মসলা পাঠাতে পেরেছি। গামা তেজস্ক্রিয়তা সেবা বেশি পেলে রপ্তানি আরও কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। ভারতে এ ধরনের সেবা দিতে ২৬টি গামা তেজস্ক্রিয়তা কেন্দ্র চালু আছে। আর সেখানে আমাদের মাত্র ৪টি তেজস্ক্রিয়তা কেন্দ্র নির্মাণাধীন।’

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বিদেশে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি মানুষের বসবাস। তাই তাঁদের কাছে দেশের মসলার চাহিদাও বেশি। এ ছাড়া আরও কিছু পণ্য রপ্তানি হয়, যেগুলো আন্তর্জাতিক মানে জীবাণুমুক্ত করার পরই শুধু রপ্তানি করা যায়। এসব পণ্যের রপ্তানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার পণ্য গামা তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করা হয়। কিন্তু চাহিদা রয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের পণ্যের। তাই আমাদের আইড্রপ বা আই ওয়েন্টমেন্টের টিউব বিদেশ থেকে জীবাণুমুক্ত করা অবস্থায় আনতে হচ্ছে। ফলে খরচ বেশি হচ্ছে।’

বিকল্প ‘ইলেকট্রনিক বিম প্রযুক্তি’

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘তেজস্ক্রিয় উৎস: প্রয়োগ ও বিকল্প প্রযুক্তি’ এক গবেষণার তথ্য বলছে, খাদ্য জীবাণুমুক্ত করতে এখন ‘কোবাল্ট-৬০’ভিত্তিক নতুন তেজস্ক্রিয়তা কেন্দ্র খুব কমই নির্মিত হচ্ছে। এর পরিবর্তে এখন ইলেকট্রনিক বিম বা ই-বিম প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। চীন এই খাতে প্রতিবছর বিপুল বিনিয়োগ করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোবাল্ট-৬০ উৎস থেকে গামা রশ্মি চারদিকে সমানভাবে নির্গত হয়। সেখানে ই-বিম রশ্মি নির্দিষ্ট দিকে প্রক্ষেপণ করা হয়। ফলে ই-বিম ব্যবহার করে কম সময়ে খাদ্যপণ্য জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব।

আইআরপিটির পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, ‘ইলেকট্রিসিটিকে তেজস্ক্রিয়তা শক্তিতে রূপান্তর করে জীবাণুমুক্ত করা হয়। তাই এটি প্রক্রিয়াজাত ও স্থাপনেও খরচ কম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যতক্ষণ না এগিয়ে আসছে, তত দিন এই খাতে আমাদের এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। কারণ, একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এতগুলো তেজস্ক্রিয় কেন্দ্র চালানো কঠিন।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে আরও কিছু রেডিয়েশন প্ল্যান্ট তৈরি করা গেলে মসলা, শুকনা খাবার ও মেডিকেল পণ্যের পাশাপাশি শাকসবজি, ফলমূল ও প্রাণী খাদ্যও নিয়মিতভাবে জীবাণুমুক্ত করে রপ্তানি করা যেত। এতে রপ্তানি আয় আরও বাড়ত।