গবেষণা ও উদ্ভাবনে পিছিয়ে বাংলাদেশ

গবেষণা ও উদ্ভাবনে পিছিয়ে বাংলাদেশ

বিনা ডেস্ক।
গবেষণা ও উন্নয়নে (আরঅ্যান্ডডি) এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে মৌলিক গবেষণা খুবই কম। অথচ তুমুল প্রতিযোগিতার বিশ্ববাজারে প্রায় সব ক্ষেত্রেই এখন উদ্ভাবনী পণ্য, প্রযুক্তি ও কৌশলেরই আধিপত্য। উদ্ভাবনী পণ্য ও সেবার জয়জয়কার সর্বত্র। দেশে গবেষণার এই দুর্গতির পেছনে অন্যতম কারণ গবেষণা ও উন্নয়নে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ নেই। নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও ততটা গুরুত্ব পায় না গবেষণা ও উদ্ভাবন। সরকারি কিংবা বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই প্রায় একই চিত্র। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রথমবারের মতো এ সম্পর্কিত একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে গবেষণা ও উন্নয়নে (আরঅ্যান্ডডি) ব্যয় হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ। এটি সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকারও কম। এ খাতে দেশে মাথাপিছু ব্যয় মাত্র ৬২০ টাকা। মাথাপিছু হিসেবে দেশের প্রতি ১০ লাখ লোকের বিপরীতে গবেষক আছেন মাত্র ১০৭ জন। কর্মী আছেন ১৮৭ জন। অন্যদিকে প্রতি এক হাজার শ্রমশক্তির বিপরীতে গবেষক আছেন শূন্য দশমিক ২৫ জন। প্রতি এক হাজার চাকরির বিপরীতে গবেষক আছেন শূন্য দশমিক ২৬ জন। 
গবেষণা এবং উন্নয়ন নিয়ে আরও উদ্বেগের পরিসংখ্যান হচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছরই জিডিপির অনুপাতে গবেষণা ও উন্নয়নে (আরঅ্যান্ডডি) ব্যয় কমছে। যেমন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল জিডিপির শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। পরের অর্থবছরে (২০১৯-২০) তা কমে হয় শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশে। ২০২০-২১ অর্থবছর তা আরও খানিকটা কমে এসেছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে উন্নতি তো নেই, বরং অবনতি হচ্ছে দিন দিন। 


সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য নিয়ে জরিপটি করা হয়। ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভে ২০২২’ শিরোনামের জরিপটিতে সরকারি-বেসরকারি ৪৯৭টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, দেশে গবেষক আছেন মাত্র ১৮ হাজার ২৫ জন। তাদের মাত্র ১০ দশমিক ৮২ শতাংশ নারী। প্রযুক্তবিদের সংখ্যা মাত্র তিন হাজার ৫২ জন। তাদের ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ নারী। 

কেন গবেষণা ও উন্নয়নে (আরঅ্যান্ডডি) জাতীয় মনোযোগ নেই। শিল্পখাতে এর প্রভাব কী পড়ছে–জানতে চাইলে পোশাক খাতের উদ্যোক্তা হান্নান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, গবেষণা ও উন্নয়ন শিল্পের আদি-অন্ত বুঝতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তগুলো হাতে পাওয়া যায়। বাজার চাহিদা বোঝা যায়। কোন দেশের বাজারে কোন মৌসুমে কী ধরনের কী রঙের পণ্যের চাহিদা তৈরি হয় তা বোঝা যায়। কিংবা আগামীর ফ্যাশনের ট্রেন্ড বোঝা কিংবা পণ্য উন্নয়ন–যাই বলা হোক না কেন গবেষণা ও উন্নয়ন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই। কার্যকর গবেষণা ও উন্নয়নের অভাবে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে প্রতিপদে পিছিয়ে আছে। 


তিনি বলেন, নিয়মিত গবেষণা ও উন্নয়ন হয় না বলেই অনেক সময় চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা কয়েকগুণ বাড়ায় কোনো কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ। অথচ দেখা যায়, বিশ্ববাজারে সংশ্লিষ্ট পণ্যের চাহিদা বাড়েনি বরং কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে কম দামে অন্য কারখানার ক্রেতা টানার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। এ কারণেও পোশাকের ন্যায্য দর পাওয়া যায় না। অন্যদিকে আমাদের পণ্যের দ্বিগুণ দরে অন্য দেশ থেকে পণ্য নেয় ক্রেতারা। আমরা পরিমাণে বেশি রপ্তানি করি। গবেষণা ও উন্নয়নের অভাবে এর চেয়ে বড় খেসারত আর কী রয়েছে! 

গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে– মৌলিক, পরীক্ষামূলক ও ফলিত গবেষণা। বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, মোট গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে সর্বনিম্ন ব্যয় হচ্ছে মৌলিক গবেষণা কাজে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মৌলিক গবেষণায় খরচ হয়েছে ৯৪১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা এ খাতে মোট ব্যয়ের মাত্র ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি মোট ব্যয়ের ৫২ দশমিক ৭ শতাংশই হয়েছে পরীক্ষামূলক উন্নয়নে। এ ছাড়া ফলিত গবেষণায় ব্যয় হয়েছে মোট ব্যয়ের ৩৭ দশমিক ৪০ শতাংশ অর্থ। মৌলিক গবেষণায় কম ব্যয়ের কারণ প্রসঙ্গে বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করা প্রতিষ্ঠানগুলো মৌলিক গবেষণায় বিনিয়োগের পরিবর্তে নতুন পণ্য ও প্রক্রিয়া বিকাশের দিকেই বেশি মনোনিবেশ করছে। 

বিবিএসের জরিপে দেখা যায়, গবেষণায় তুলনামূলক বেশি ব্যয় হয় কৃষি খাতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে আরঅ্যান্ডডিতে ব্যয় হয় ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। অন্যান্য খাতের মধ্যে ‍শিক্ষায় ১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা, চিকিৎসায় ৯২৭ কোটি ৬২ টাকা, পরিবেশে ৮৪৭ কোটি টাকা, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ ও অবকাঠামোয় ৭৩৭ কোটি টাকা এবং শিল্প খাতে ৩৩১ কোটি টাকার সামান্য কিছু বেশি ব্যয় হয়েছে আরঅ্যান্ডডিতে। 

গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) সম্পর্কিত বিভিন্ন সূচক প্রস্তুত করা এবং জাতীয় উদ্ভাবনী অবস্থান মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এছাড়া জরিপের মাধ্যমে জাতীয় উদ্ভাবনী ব্যবস্থার গতিশীলতা চিহ্নিত করা, এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় আনতে সহায়তা করাও এর উদ্দেশ্য ছিল। আশা করা হচ্ছে, এসব পরিসংখ্যান সরকারের নীতিনির্ধারণে সহায়ক হবে। উপকৃত হবে বেসরকারি খাতও। 

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোট গবেষক আছেন ১৮ হাজার ২৫ জন। তাদের মধ্যে ৮ হাজার ৩৮৭ জনের সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা মাস্টার্স ডিগ্রি, ৫ হাজার ৮৪০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারী ও ১ হাজার ২৮৩ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকেরও কম। গবেষণায় পিএইচডি ও উচ্চতর ডিগ্রিধারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম, মাত্র ২ হাজার ৫১৪ জন। অথচ বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট পিএইচডি ডিগ্রিধারী আছেন ৫১ হাজার ৭০৪ জন। সে হিসেবে পিএইচডি ডিগ্রিধারীর প্রায় ৯৫ শতাংশই গবেষণায় যুক্ত নেই।

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিশ্বের মধ্যে পেছনের সারির দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এমনকি এশিয়া অঞ্চলের মধ্যেও। ২০২২ সালের বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থান ছিল ৪০তম। দক্ষিণ এশিয়ার আরও দুটি দেশ শ্রীলঙ্কা ৮৫তম ও পাকিস্তান ৮৭তম অবস্থানে। অথচ এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২তম। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণ, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১) বাস্তবায়ন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণায় বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে। কারণ প্রযুক্তি ও প্রতিযোগিতার এই যুগে মানসম্পন্ন গবেষণা ও উদ্ভাবনের কোনো বিকল্প নেই।