৭০০ কোটি টাকা ঋণঃ ফেরত পাবে সরকার?

৭০০ কোটি টাকা ঋণঃ ফেরত পাবে সরকার?

পোশাক খাতের শ্রম অসন্তোষ নিরসনে দুই বছরে সরকার ১২টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৭০৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে আটটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সরকার সেই ঋণ ফেরত পাচ্ছে না। দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ শোধের মেয়াদ শেষ হবে চলতি মাসে। বাকি দুটির একটির আগামী মাসে, আরেকটির ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শেষ হবে।

ঋণের টাকা ফেরত চেয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগাদা দিচ্ছে সরকার। শুধু তা-ই নয়, বন্ধক থাকা সম্পত্তি বিক্রিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

মোট ঋণের মধ্যে অর্থ বিভাগের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে ৬২৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছে ৮১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ১ মাস, ৩ মাস, ৬ মাস ও ২ বছরের মধ্যে পরিশোধ করার শর্তে এসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ঋণ নেয় ৫ কোটি টাকা। সংগঠনটি অবশ্য এ টাকা ফেরত দিয়েছে। এ ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠান ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা ও আরেকটি প্রতিষ্ঠান ৬৫ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে। ঋণের টাকা চেয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় তাগিদপত্র দিয়ে এলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান জবাব দিচ্ছে না।

জানতে চাইলে শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শ্রম অসন্তোষ নিরসনে ঋণ আকারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে টাকা দেওয়া হয়েছে। এ টাকা তাদের ফেরত দিতে হবে। না হলে তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায়ের উদ্যোগ নেবে সরকার।

অর্থ বিভাগ কত ঋণ দিল

অর্থ বিভাগ সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপকে। গ্রুপটিকে গত ৬ মার্চ ৫২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা দেওয়া হয় ৬ মাসের জন্য। বেক্সিমকো ফ্যাশন লিমিটেডকে ৫০ কোটি টাকা দেওয়া হয় ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর। এ ছাড়া বার্ডস গ্রুপকে ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর ৬ মাসের জন্য ১৪ কোটি, ডার্ড গ্রুপকে ১০ ডিসেম্বর ৬ মাসের জন্য ১৩ কোটি এবং নায়াগ্রা টেক্সটাইলসকে এ বছরের ৪ জুন ২ মাস ২৩ দিনের জন্য ১৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় অর্থ বিভাগ।

বার্ডস গ্রুপের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১১ মে ও ডার্ড গ্রুপের মেয়াদ ২৭ মে শেষ হয়েছে। নায়াগ্রা গ্রুপের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ আছে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত। এ ছাড়া টিএনজেড গ্রুপ গত বছরের ২৮ নভেম্বর ৬ মাসের জন্য নিয়েছে ১০ কোটি টাকা। এটির পরিশোধের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।

টিএনজেড গ্রুপের মূল পরিচালক শাহাদাৎ হোসেন শামীম বিদেশে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। এ গ্রুপের পরিচালক শরিফুল শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রুপের ওয়াশিং প্ল্যান্ট ও ঢাকায় মালিকের বাড়ি বিক্রির একটি উদ্যোগ রয়েছে। তবে টাকা পরিশোধের জন্য তিন মাস সময় চাওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

কেন্দ্রীয় তহবিলের ৭৬ কোটি টাকা

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে ঋণ নিয়েছে ১০টি কোম্পানি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে টিএনজেড গ্রুপ। এই গ্রুপ গত বছরের ২৮ নভেম্বর ৬ কোটি টাকা নিয়েছে ৬ মাসের জন্য। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলেও ঋণ পরিশোধ হয়নি। এ বছরের ২৮ মে এ গ্রুপ দ্বিতীয় দফায় নিয়েছে ২২ কোটি টাকা, যা পরিশোধের মেয়াদ শেষ হবে ২৮ আগস্ট।

তহবিলটি বেক্সিমকো ফ্যাশন লিমিটেড থেকে ৬ মাসের জন্য নিয়েছে ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া বার্ডস গ্রুপ ৫ কোটি এবং নায়াগ্রা টেক্সটাইলস নিয়েছে ৫ কোটি টাকা। নায়াগ্রা টেক্সটাইলস ছাড়া সবারই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শেষ হয়েছে।

কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে মাহমুদ জিনস লিমিটেড এ বছরের ২৮ মে তিন মাসের জন্য ২১ কোটি টাকা, রোয়ার ফ্যাশনস ২৭ মার্চ ৩ মাসের জন্য ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং ইয়েলো অ্যাপারেলস গত বছরের ২০ নভেম্বর ৬ মাসের জন্য ৩৭ লাখ টাকা নিয়েছে।

এদিকে ঋণের বিপরীতে বন্ধক থাকা ঢাকার গুলশানে মাহমুদ জিনসের ৭ দশমিক ৫ কাঠার একটি বাড়ি বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। মূল মালিকই বাড়িটি বিক্রি করবেন। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব শুধু ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। জানা গেছে, সম্ভাব্য ক্রেতারা ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত আগ্রহ দেখালেও বিক্রেতা ১০০ কোটি টাকার নিচে নামতে চাইছেন না।

আওয়ামী লীগ আমলে ১১ কোটি

অন্তর্বর্তী সরকারের আগে আওয়ামী লীগের আমলে কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে ১১ কোটি টাকা। এরমধ্যে ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল গোল্ডস্টার গার্মেন্টস ৩ মাসের কথা বলে নিয়েছিল ১ কোটি টাকা । তারও আগে ২০২৩ সালে স্টাইল ক্র্যাফট লিমিটেড ৩ মাসের জন্য ৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। একই বছরের ১৮ এপ্রিল ১ মাসের জন্য ৫ কোটি টাকা নিয়েছিল খোদ পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

এদিকে ঋণের টাকা ফেরত চেয়ে গত ১০ জুলাই ৭টি প্রতিষ্ঠানকে তাগিদ দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

বিদেশে যাতে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য ১২টি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত মার্চ মাসে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সূত্রগুলো জানায়, নিষেধাজ্ঞা জারির আগে থেকেই তাঁদের অনেকে বিদেশে অবস্থান করছেন।

সার্বিক বিষয়ে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সমস্যার উৎসের দিকে যেতে হবে। সরকার যেটাকে শ্রম অসন্তোষ বলছে, বাস্তবে তা বকেয়া বেতন। বকেয়া বেতনের দাবিতে যে আন্দোলন হয়, তা দূর করার অন্যতম উপায় হচ্ছে, মালিকপক্ষ যদি সব সময় দুই মাসের আপৎকালীন মজুরির টাকা ব্যাংকে জমা রাখে, তাহলে এত টাকা ঋণও দিতে হবে না, মালিকদের বাড়িও বিক্রি করতে হবে না।