২৬ বছর পর প্রিমিয়ার ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন, নেপথ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক

‘আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা’ করতে প্রিমিয়ার ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙ্গে তা নতুন করে গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক; যার মধ্য দিয়ে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর এটির পর্ষদ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. এইচ বি এম ইকবালের পরিবারের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হল।
মঙ্গলবার এইচ বি এম ইকবালের ছেলে মোহাম্মাদ ইমরান ইকবালের নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের পর্ষদ ভেঙে ছয় সদস্যের নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ছয় সদস্যের নতুন পর্ষদে ব্যাংকটির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার ডা. আরিফুর রহমান পরিচালক এবং অন্যরা স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিক।
এর মাধ্যমে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটির পর্ষদে আওয়ামী লীগ নেতা ডা. ইকবালের পরিবারের কেউ থাকলেন না।
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চলতি বছর জানুয়ারিতে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে ২৬ বছর পর সরে দাঁড়ান প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডা. ইকবাল। এরপর পর্ষদে চেয়ারম্যান হন তার ছেলে মোহাম্মদ ইমরান ইকবাল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার বলেন, “আগের পর্ষদে সুশাসনের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। এজন্য ব্যাংকটিতে নতুন পর্ষদ দেওয়া হয়েছে। নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও দুর্বলতা এবং নিয়ম শৃঙ্খলাতে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছিল।”
ব্যাংকটিতে ‘আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা’ করতেই এমন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে কোনো ব্যাংকে এমন ঘটনা (আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না) ঘটছে তখন পর্ষদ ভেঙে দিতে পারে।
মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন পর্ষদ গঠন করে দেওয়ার আগে সবশেষ আট সদস্যের পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ডা. ইকবালের ছেলে মোহাম্মাদ ইমরান ইকবাল, যিনি জানুয়ারিতে এ দায়িত্ব নেন। তার সঙ্গে পর্ষদে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক ফুটবলার আব্দুস সালাম মুশের্দী পরিচালক হিসেবে ছিলেন।
গণ অভ্যুত্থানে পট পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদ গঠন করে দেওয়ার সময়কালে নিজে থেকেই সরে দাঁড়ান প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডা. ইকবাল। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন ১২ জানুয়ারি। দুদিন পর তা গ্রহণ করা হয়।
সেসময় তার সঙ্গে ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা তার আরেক ছেলে মঈন ইকবালও পদত্যাগ করেন। তিনি কোনো কারণ না দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পিতা-পুত্র দুজনই পরিচালক হিসেবেও সরে দাঁড়ান।
এরপর তার আরেক ছেলে মোহাম্মাদ ইমরান ইকবালকে চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়।
ব্যাংকাররা বলছেন, আওয়ামী লীগের সাবেক এই সংসদ সদস্য নিজে সরে গিয়ে কৌশলে পর্ষদে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পদত্যাগ করেছিলেন।
এর আট মাস পর বেসরকারি খাতের ব্যাংকটির পর্ষদে ‘সুশাসনের ঘাটতি’ থাকাকে কারণ দেখিয়ে তা ভেঙে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এইচ বি এম ইকবাল বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তও নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক বলছে, “ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ২০১১ সাল থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে থাকার পাশাপাশি গুলশানে হোটেল রেনেসাঁ, গুলশান-২ এ হিলটন হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা নির্মাণ করেছেন।”
এসময়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সদস্যও ছিলেন তিনি।
ডা. ইকবাল গত এক যুগে এমন অসংখ্য কোম্পানির মালিক হয়েছেন এবং ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে থেকে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন বলে দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে।
নতুন পর্ষদে যারা আছেন
ব্যাংকটিতে উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে পরিচালক করা হয়েছে ডা. আরিফুর রহমানকে।
বাকি ৫ স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. ফোরকান হোসেন, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ফরিদুল ইসলাম, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ এর অধ্যাপক শেখ মোর্শেদ জাহান এবং এফসিএস চার্টার্ড সেক্রেটারি এম নুরুল আলম।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্টের পর থেকে এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৫টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করল।
ব্যাংকগুলো হল
ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী, আইএফআইসি, ইউসিবি, এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি, আল আরাফাহ ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, ন্যাশনাল, এনআরবি, এনআরবিসি, মেঘনা ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।