পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত

পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এছাড়া দেড় দশক ধরে অকার্যকর থাকা বাংলাদেশ-পাকিস্তান জয়েন্ট ইকোনমিক কমিশন কার্যকর করা হবে বলেও জানান তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সচিবালয়ে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের সঙ্গে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা এসব কথা জানান।
এ সময় উপদেষ্টা বলেন, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর ৮০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, যার মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলারের খাদ্য এবং মধ্যবর্তী পণ্য। দুই দেশের মধ্যে এসব পণ্য বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগ আছে, সেটি দেখার জন্য নতুন বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, কৃষি ও খাদ্যপণ্য, ফল আমদানি-রপ্তানি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে চিনি উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়াতে পাকিস্তানের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। মধ্যবর্তী পণ্য উৎপাদনে পাকিস্তানের বিনিয়োগ চেয়েছি। তারা আমাদের সব প্রস্তাব ইতিবাচকভাবে দেখেছে। নতুন কমিশনে এসব বিষয়ে আলোচনা হবে। উপদেষ্টা আরও বলেন, দুই দেশ যৌথভাবে বা বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে মধ্যবর্তী পণ্য উৎপাদন করতে পারলে তা উভয় দেশের জন্য লাভজনক হবে।
উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের ওপর পাকিস্তান অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করে রেখেছে। সেটি প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয়েছে। প্রত্যাহারে তারা আশ্বাস দিয়েছেন। আমাদের চামড়া ও চিনিশিল্প উন্নয়নে পাকিস্তানের সহায়তা চেয়েছি।
বশিরউদ্দীন বলেন, এক সময় পাকিস্তান আমাদের ১ কোটি কেজি চা রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিত, তা আবার বহাল করার অনুরোধ করা হয়েছে। এ সুবিধা দিতে তারা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ালে ভারতের সঙ্গে আরও বৈরিতা বাড়বে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার কাজ হচ্ছে বাণিজ্যে সক্ষমতা তৈরি করা। এ বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করুন। এটি আমার বিষয় নয়। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দেশের স্বার্থে অন্য যে যে দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো প্রয়োজন, আমরা সেটিই করব।’
বাংলাদেশ পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে কিনা এ প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা সবার দিকে ঝুঁকছি। পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকছি। ভারত থেকেও পেঁয়াজ আনছি। সবার আগে বাংলাদেশের স্বার্থ, যেখানে দেশের স্বার্থ আছে, সেখানেই ঝুঁকছি।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যে পাওনা দেনা ছিল সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি। এটি বাণিজ্যের বিষয় না। পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রীর এবারের সফরে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বেশকিছু সমঝোতা সই হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবর রহমান বলেন, ‘গত দেড় দশক পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য তেমন ছিল না বললেই চলে। খাদ্য, পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য আমরা নানা দেশ থেকে আমদানি করি, প্রতিযোগিতা দরে পাকিস্তান থেকে এসব পণ্য আনা গেলে ভালো হবে। একই সঙ্গে আমাদের রপ্তানি বাড়ানোকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে পাকিস্তান থেকে আমদানি বেশি হলেও রপ্তানি তুলনামূলক কম। রপ্তানি বাড়াতে পারলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।’
তিনি আরও বলেন, গত অর্থবছর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৭৮৭ মিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানে রপ্তানি করেছে ৭৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
গতকাল পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের সঙ্গেও দেখা করেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ে এই সাক্ষাৎ হয়। এ সময় খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে। এর মাধ্যমে দুই দেশের বাণিজ্য কার্যক্রম বেড়েছে। আগে পাকিস্তানি পণ্য তৃতীয় দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে আমদানি হতো। এতে সময় ও খরচ বাড়ত। পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সঙ্গেও গতকাল সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী। মতিঝিলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালেও শিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও পাকিস্তানের হালাল অথরিটির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের বিষয়ে আলোচনা হয়।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। গতকাল ডিসিসিআইয়ের মতিঝিল কার্যালয়ে সাক্ষাৎকালে তাসকীন আহমেদ বলেন, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের দিক দিয়ে দুই দেশের মানুষের প্রচুর মিল রয়েছে। পাকিস্তানের টেক্সটাইল, জুয়েলারি পণ্য এ দেশের মানুষের কাছে বেশ চাহিদা রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান ও কার্গো যোগাযোগ চালু হলে ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়বে।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়ই রপ্তানির ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক এবং টেক্সটাইল খাতের ওপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীল। রপ্তানি পণ্যে উভয় দেশকেই পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। তিনি উল্লেখ করেন, ইউরোপের দেশগুলোসহ কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত পোশাকের নতুন নকশার মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে, যেখানে দুই দেশের পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মনোনিবেশ করা আবশ্যক, যার মাধ্যমে রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
সিমেন্ট, চিনি, পাদুকা ও চামড়া খাতে পাকিস্তানের বেশ ভালো করছে। বাংলাদেশ চাইলে পাকিস্তান থেকে এসব পণ্য আমদানি করতে পারে, পাশাপাশি ওষুধ খাতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা পাকিস্তানের জন্য বেশ কার্যকর হবে বলে মতপ্রকাশ করেন পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে শিগগিরই বাংলাদেশে ‘সিঙ্গেল কান্ট্রি এক্সিবিশন’-এর আয়োজন করা হবে, যার মাধ্যমে দুই দেশের বেসরকারি খাতের সম্পর্ক আরও জোরদারের সুযোগ তৈরি হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সফরকালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানো, বিনিয়োগের নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার বিষয়ে আলোচনা হবে। এ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে চারটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হওয়ার কথা রয়েছে। পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ছাড়াও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। পাশাপাশি সফরের অংশ হিসেবে তিনি চট্টগ্রাম বন্দর, একটি ওষুধশিল্প প্রতিষ্ঠান ও একটি ইস্পাত কারখানা পরিদর্শন করবেন।