ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী কানাডা, তবে জুড়ে দিয়েছে শর্ত

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী কানাডা, তবে জুড়ে দিয়েছে শর্ত
ছবিঃ রয়টার্স

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে কানাডা। দেশটির প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনি জানিয়েছেন, দেশটি চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে কানাডা হতে যাচ্ছে তৃতীয় জি৭ দেশ যারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি জানিয়েছে।

তবে শর্ত জুড়ে দিয়েছে কারনি। তিনি বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত তখনই কার্যকর হবে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ আগামী ২০২৬ সালে হামাসকে বাদ দিয়ে নির্বাচন আয়োজন ও প্রয়োজনীয় গনতান্ত্রিক সংস্কার কার্যক্রমে সম্মত থাকে।

এই মন্তব্য তিনি দেন যুক্তরাজ্যের ঘোষণার একদিন পর। যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, যদি ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে ও অন্যান্য শর্তে সম্মত না হয়, তাহলে তারা সেপ্টেম্বরেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে। এর এক সপ্তাহ আগেই ফ্রান্সও একই ধরনের পরিকল্পনার কথা জানায়।

কানাডার এই ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করেছে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একে তারা আখ্যা দিয়েছে 'হামাসকে পুরস্কার দেওয়ার শামিল' বলে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৪৭টি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে।

কারনি জানিয়েছেন, জাতিসংঘের পরবর্তী সাধারণ অধিবেশনে কানাডা আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।

তিনি বলেন, দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতির সম্প্রসারণ, গাজায় মানবিক সংকটের চরম অবনতি এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার ঘটনায় কানাডার পররাষ্ট্রনীতিতে এই নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে।

'গাজায় মানুষের দুর্ভোগ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং পরিস্থিতি দ্রুত আরও খারাপ হচ্ছে,' বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন কারনি।

তিনি আরও জানান, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে—ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ শাসনব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কার আনে কি না এবং তারা অঞ্চলটিকে নিরস্ত্রীকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কি না, তার ওপর।

কারনি বলেন, কানাডা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার মাধ্যমে শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে দুই-রাষ্ট্র সমাধানকে সমর্থন করে এসেছে। তবে তিনি যোগ করেন, 'এই পদ্ধতি আর গ্রহণযোগ্য নয়।'

'একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনাই আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে,' বলেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে কারনি জানান, ওই দিনই তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন।

ফাতাহ দলের মাধ্যমে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীরের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন আব্বাস। অপরদিকে গাজা শাসন করছে হামাস। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই দুই অঞ্চলের কোথাও ২০০৬ সালের পর আর কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।

কারনির ঘোষণার সমালোচনা করে আবারও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে মন্ত্রণালয় জানায়, কানাডার এই পরিকল্পনা 'গাজায় যুদ্ধবিরতি অর্জনের প্রচেষ্টা এবং জিম্মিদের মুক্তির কাঠামো তৈরির পথকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।'

ঘোষণাটির বিরোধিতা করেছে কানাডার বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টিও। '৭ অক্টোবরের সন্ত্রাসী হামলার পরপরই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া বিশ্বকে ভুল বার্তা দেয়,' দলটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে।

কানাডার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সম্প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানানোয় প্রধানমন্ত্রী কারনির ওপরও চাপ বেড়েছে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

এমন এক প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার প্রায় ২০০ জন সাবেক কানাডীয় রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করে কারনিকে আহ্বান জানান ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য।

চিঠিতে বলা হয়েছে, 'গাজায় ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি, বাছবিচারহীন বোমাবর্ষণ ও অনাহারে মৃত্যুর পাশাপাশি পশ্চিম তীরে চরমপন্থী বসতকারীদের সহিংস হামলার মাধ্যমে কানাডার নীতিমালা প্রতিদিন লঙ্ঘিত হচ্ছে।'

যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সিদ্ধান্তে তিনি প্রভাবিত হয়েছেন কি না, কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না—এই প্রশ্নের জবাবে কারনি বলেন, কানাডা তার পররাষ্ট্রনীতি স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করে।

যদি ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ হয়ে থাকবে যারা এখনো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি, যদিও দেশটি ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র।

হামাসের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে চালানো হামলায় প্রায় ১,২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নেওয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এরপর থেকে গাজায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে আরও ১৫৪ জনের, যাদের মধ্যে ৮৯ জন শিশু।