প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শেয়ারবাজার, চার মাসে বাজারমূল্যে বেড়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা

ক্রমাগত দর পতনের পর গত জুন থেকে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শেয়ারবাজার। শেয়ার দরের সঙ্গে সূচক এবং লেনদেনও বেড়েছে। দর বৃদ্ধির ধারা স্পষ্ট হওয়ার পর পুরোনোদের সঙ্গে নতুন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর শেয়ার কেনা শুরু করেছিল গত মে মাস থেকেই।
গত ১৩ মাসে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার ধারণের হার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মোট শেয়ার ধারণের পরিমাণ ক্রমে কমে যায়। মে মাস থেকে বাড়ছে। এর পর থেকে চার মাস ধরে বাড়ছে। এ পর্যালোচনায় মিউচুয়াল ফান্ডের হিসাব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
গত মাসে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অ্যাকাউন্টে বৃদ্ধি পাওয়া শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। বাজারমূল্য বিবেচনায় প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্টে গত মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসে যে পরিমাণ শেয়ার বেড়েছে, তার মোট মূল্য ছিল প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিপরীতে এ সময়ে যেসব কোম্পানি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার কমেছে, তার মোট বাজারমূল্য ছিল এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এই হিসাবে গত দুই মাসে দেড় থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে।
গত এপ্রিল থেকে তালিকাভুক্ত ৩৬০ কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ধারণ করা মোট শেয়ার ছিল ২১ কোটি ৪৮ লাখ। গত আগস্ট শেষে যা বেড়ে ২২ কোটি ১২ লাখ হয়েছে। এই চার মাসে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বেড়েছে ৬৪ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রতি মাসে কিছু কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার বেড়েছে, কিছু কোম্পানিতে কমেছে। অবশ্য বাজার দর বিবেচনায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ধারণ করা মোট শেয়ারের বিনিয়োগ মূল্য গত জুন থেকে বাড়ছে।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাংক, বীমা, মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকার ডিলার প্রতিষ্ঠান যেমন আছে, তেমনি অনেক কৌশলী বিনিয়োগকারী নিজ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা শুধু শেয়ারে লগ্নি করার জন্য ট্রেড লাইসেন্সনির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে বিও অ্যাকাউন্ট খুলেও শেয়ার কিনেছেন।
একাধিক শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের এমডিরা জানান, প্রাতিষ্ঠানিক বা কৌশলী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ধরন হলো– তারা আগাম বিনিয়োগ করে। অনেক তথ্য-উপাত্ত জেনে এবং বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা শেয়ার দর বাড়তে থাকার পর বিনিয়োগে আগ্রহী হন। চলতি ঊর্ধ্বমুখী ধারায় এর ব্যতিক্রম হয়নি।
গত আগস্ট শেষে তালিকাভুক্ত ৩৬০ কোম্পানির মধ্যে ৩৫৮টিতেই কম-বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার থাকার তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে ২৬৭ কোম্পানিতে মোট শেয়ারের অন্তত ১০ শতাংশ শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের। এর মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ছিল ১১৮ কোম্পানিতে। ২০ শতাংশের বেশি থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ছিল আরও ৯৮টির। এর বেশি হারে শেয়ার রয়েছে আরও ৫১টিতে।
আগস্টের চিত্র
গত মাসে কম-বেশি ২২৩ কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার বেড়েছে। এর মধ্যে মোট শেয়ার বিবেচনায় অন্তত ১ শতাংশীয় পয়েন্ট শেয়ার বেড়েছে ৯৫টিতে। বিপরীতে ১১০ কোম্পানি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার কমেছে। এর মধ্যে অন্তত ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে ৩২ কোম্পানি থেকে।
অন্য এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মোট বাজারমূল্য বিবেচনায় বৃদ্ধি পাওয়া শেয়ারের মোট মূল্য অন্তত ১ কোটি টাকা বা তার বেশি ছিল এমন কোম্পানি ১৪৯টি। অর্থাৎ বৃহৎ বাজার মূলধনি কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ তুলনামূলক বেশি ছিল। এর মধ্যে এগিয়ে ছিল ওরিয়ন ইনফিউশনস, ইনফরমেশন সার্ভিসেস, ইন্ট্রাকো, সিনোবাংলা, রেনাটা, সি পার্ল, ওয়াটা কেমিক্যাল, লাভেলো, বিএটি বাংলাদেশ, রবি, ওরিয়ন ফার্মাসহ কয়েকটি কোম্পানি। অবশ্য বাজারে এমন প্রবণতা রয়েছে, কারসাজি চক্র কখনও ব্যক্তি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্টে এবং কখনও প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্ট থেকে ব্যক্তি অ্যাকাউন্টে শেয়ার কেনাবেচা করে থাকে।
শতাংশীয় পয়েন্ট বিবেচনায় তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ইনফরমেশন সার্ভিসেস কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ধারণ করা শেয়ারের হার বেড়ে ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা গত জুলাইয়ের শেষেও ছিল পৌনে ৯ শতাংশ। এই হিসাবে এ কোম্পানির শেয়ারে গত আগস্টে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ হয়েছে অন্তত ৩০ কোটি টাকার। এর পরের অবস্থানে ছিল সিনোবাংলা (১৯.৪৯%), ইন্ট্রাকো সিএনজি (১৩.০৪%), ওয়াটা কেমিক্যাল (১১.৩৯%), হামি (১১.৩৯%), এবি ব্যাংক (৯.৭৪%), প্রথম প্রাইম ফাইন্যান্স প্রথম মিউচুয়াল ফান্ড (৮.৭%), ডমিনেজ স্টিল (৭.২৩%), ইনটেক (৬.৭২%) এবং ই-জেনারেশন (৬.৪%)।
এদিকে শেয়ার ধারণের হার বিবেচনায় কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার কমেছে সবচেয়ে বেশি। গত জুলাই শেষে সাধারণ বীমা খাতের এ কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার ছিল মোটের ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আগস্ট শেষে যা নেমেছে ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশে। একইভাবে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স, সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স, সিমটেক্স, কাট্টলী টেক্সটাইল এবং আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে ২ থেকে প্রায় ৪ শতাংশীয় পয়েন্ট প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার কমেছে।
টাকার হিসাবে গত চার মাসে প্রাতিষ্ঠানিক বেশি বেড়েছে স্কয়ার ফার্মা, সিটি ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, লাফার্জ-হোলসিম সিমেন্ট, ব্যাংক এশিয়া, বিএটি বাংলাদেশ, রেনাটা, রবি, বেক্সিমকো ফার্মা, গ্রামীণফোন, ফাইন ফুডস, মালেক স্পিনিং, ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ও অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজে।