বেগুনে ক্ষতিকর ধাতু, মাটিদূষণে অন্য সবজি নিয়েও শঙ্কা
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্রে বলা হয়, বিভিন্ন বিষাক্ত ধাতুর মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যে দূষণ বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ তৈরি করেছে। বর্তমান গবেষণায় বাংলাদেশে বেগুন উৎপাদনকারী হটস্পট অর্থাৎ জামালপুর জেলা থেকে সংগ্রহ করা ভূমির ওপরের দিকের মাটি ও বেগুনে এসব ধাতুর উপস্থিতির মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে।
বারোমাসি সবজি বেগুনে কয়েকটি ভারী ধাতুর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় উপস্থিতি পেয়েছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। এসব ধাতু একটানা মানবদেহে প্রবেশ করলে ক্যানসারসহ বেশ কিছু জটিল রোগের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বাকৃবির কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন গবেষণার নেতৃত্ব দেন। তার দলে ছিলেন অধ্যাপক ড. কাজী ফরহাদ কাদির, অধ্যাপক ড. হারুনুর রশিদ ও বিশ্বিবিদ্যালয়ের এমএস (থিসিস) শিক্ষার্থী আনিকা বুশরা।
বিজ্ঞানবিষয়ক শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক জার্নাল সায়েন্টিফিক রিপোর্টসে চলতি বছরের ২২ আগস্ট প্রকাশিত হয় গবেষণাপত্রটি।
এই গবেষণাপত্রের উপসংহারে বলা হয়, বিভিন্ন বিষাক্ত ধাতুর মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যে দূষণ বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ তৈরি করেছে। বর্তমান গবেষণায় বাংলাদেশে বেগুন উৎপাদনকারী হটস্পট অর্থাৎ জামালপুর জেলা থেকে সংগ্রহ করা ভূমির ওপরের দিকের মাটি ও বেগুনে এসব ধাতুর উপস্থিতির মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে।
গবেষকদের দাবি, বেগুনে পুষ্টি উপাদান হিসেবে কপার, জিঙ্ক, আয়রন ও ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি রয়েছে। তবে এই সবজিতে মারাত্মক উপাদান লেড, ক্যাডমিয়াম ও নিকেলও পাওয়া গেছে। নিয়মিত বেগুন খেলে এসব উপাদান থেকে ক্যানসারসহ কিছু জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
বাকৃবি সূত্র জানায়, সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক দল গবেষণা শুরু করে। দলের সদস্যরা জামালপুরের ইসলামপুরের ১১টি ও মেলান্দহ উপজেলার ৯টি স্পট থেকে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি বেগুনের নমুনা সংগ্রহ করেন। এ সময় এই দুটি উপজেলা থেকে বেগুনের ৮০টি ও ভূমির ওপরের দিকের মাটির (টপ সয়েল) ৬০টি নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়।
বাকৃবির ল্যাবে গবেষণা চালিয়ে পাওয়া একটি ফল গত বছরের ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয়ে জমা দেন গবেষকেরা। এরপর চলতি বছরের জুনে আরও একটি ফল জমা দেয়া হয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক জার্নাল সায়েন্টিফিক রিপোর্টসে গত ২২ আগস্ট প্রকাশিত হয় গবেষণাপত্রটি।
গবেষণায় পরামর্শ দেয়া হয়েছে, অজৈব সার ও কীটনাশক এবং সেচের পানি থেকে ক্ষতিকর ধাতু বেগুনকে দূষিত করে থাকতে পারে। তবে এসব উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। দূষণের উৎস শনাক্ত এবং দূষকগুলোর বিস্তৃতির মাত্রা কমিয়ে আনতে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি নিয়মিত পরীক্ষার আওতায় আনার তাগিদও দেয়া হয়েছে গবেষণায়।
এতে বলা হয়, উদ্ভিজ্জ সরবরাহ শৃঙ্খলে বিষাক্ত উপাদানগুলোর প্রবেশকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। যেসব সবজি ও শস্যে বেগুনের চেয়েও দ্রুত হারে বিপজ্জনক ধাতুর দূষণ ঘটে থাকে, সেগুলোও পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করা উচিত।
বাকৃবির কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইউনাইটেড স্টেট এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির (ইউএসইপিএ) গাইড লাইন মেনে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।
‘আমরা দেশে বেগুন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এলাকা জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার কয়েকটি এলাকার সরাসরি বাগান থেকে বেগুনগুলো সংগ্রহ করি। এরপর সেগুলো ওভেনে শুকিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। এসব বেগুনে লেড, নিকেল, ক্যাডমিয়ামসহ একাধিক ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এগুলোর স্বাভাবিক যে পরিমাণে থাকার কথা তার থেকে কয়েক গুণ উপস্থিতি রয়েছে। এগুলো নিয়মিত মানবশরীরে প্রবেশ করলে ক্যানসারের মতো রোগ হতে পারে।’
তিনি বলেন, 'তবে এর বাইরে বেগুনে পুষ্টি উপাদান হিসেবে কপার, জিঙ্ক, আয়রন ও ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। বেগুন ও মাটির পরীক্ষা থেকে আমরা ধারণা করছি, ক্ষতিকর ধাতুগুলো খামারিদের ব্যবহার করা মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক কিংবা সেচের পানি থেকে এসেছে।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জামালপুরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মুহাম্মদ হারুন অর রশীদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেগুনে এসব ক্ষতিকর উপাদানের বিষয়ে আমাদের জানা ছিল না। তবে অনেক কৃষক না বুঝেই বেগুনে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করেন। যারা আমাদের থেকে পরামর্শ নেন তারা পরিমিত কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করেন। আমরা চাই জনপ্রিয় সবজি বেগুন উৎপাদনে কৃষক আরও সচেতন হোক।’
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. খুরশেদ আলম নিউজবাংলাকে জানান, বেগুনে হেভি মেটালের (ভারী ধাতু) উপাদান মানবদেহের কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতির কারণ হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে হেভি মেটালযুক্ত বেগুন খেলে ক্যানসারসহ লিভার ও কিডনি ড্যামেজ হতে পারে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক নিউজবাংলাকে জানান, বেগুনে পাওয়া ক্ষতিকর ধাতু দূর করার ওপরেও গবেষণা চালানো প্রয়োজন। তা না হলে বহু পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ সুস্বাদু এই সবজি খেতে অনেকে আগ্রহ হারাবেন।
বেগুনের উপকারিতা বর্ণনা করে তিনি জানান, এটি রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে৷ সেই সঙ্গে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে৷ এতে থাকে ফাইটোনিউন্ট্রিয়েন্টস নামের একধরনের উপাদান, যা মস্তিষ্কের সেল মেমব্রেনগুলোর সুরক্ষা দেয় এবং মস্তিষ্কের এক অংশ থেকে অন্য অংশে তথ্য আদান-প্রদানে সহায়তা করে৷
বেগুনে থাকা উপাদানগুলো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে৷ সেই সঙ্গে গ্লুকোজের শোষণক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার আঁশজাতীয় খাদ্য উপাদান, যা বদহজম দূর করে।
What's Your Reaction?