ঘুমের মধ্যে হাঁটা : অজানা পথে এক নিঃশব্দ যাত্রা

ফিচার ডেস্ক, বিনা
রাত গভীর। চাঁদের আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকছে। সবাই নিদ্রাবশ। হঠাৎ শব্দ হয় দরজার। কেউ একজন হাঁটছে, ধীর পায়ে। তার চোখ খোলা, কিন্তু চাহনি ফাঁকা। সে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। কথা বলে, কখনো কাঁদে, কখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কার্নিশে। আবার কিছুক্ষণ পর বিছানায় ফিরে আসে নিঃশব্দে। সকাল হলে সে নিজেও জানে না, রাতে কী ঘটেছে!
এ এক রহস্যময় জগৎ—জেগে থাকা ঘুমের ভিতর। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম ‘সমনামবুলিজম’ বা ‘স্লিপ ওয়াকিং’। বাংলায় সহজ করে বললে, ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটা। একধরনের নিঃসঙ্গ অভ্যাস, যার চিত্র রহস্য-রোমাঞ্চের উপন্যাসকেও হার মানায়।
ঘুমের ভিতর সেই 'অচেনা আমি'
যারা স্লিপ ওয়াকিং করেন, তারা কিন্তু ঘুমাতে যান সাধারণভাবেই। নরম বালিশে মাথা রাখেন, গভীর ঘুমে ডুবে যান। কিন্তু ঘুমের মাঝপথে তারা হয়ে ওঠেন এক রহস্যমানব। কেউ হয়তো বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে হাঁটছেন, কেউ হয়তো ফিসফিসিয়ে কথা বলছেন অদৃশ্য কারও সঙ্গে, আবার কেউ দাঁড়িয়ে কাঁদছেন—কিন্তু কোনো কিছুরই স্মৃতি থাকে না জাগরণের পর।
চোখ খোলা, অথচ মনের দরজা বন্ধ। তারা চলেন, কথা বলেন, কাজও করেন, কিন্তু সবকিছুই হয় চেতনাহীনভাবে। এ এক ঘোরের মতো সময়, যেখানে মানুষ নিজেই নিজের কাছে অপরিচিত।
কেন হয় এই স্লিপ ওয়াকিং?
এই রহস্যের পিছনে থাকে নানা বাস্তব কারণ:
* অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দেহের অবসাদ
* মানসিক অস্থিরতা, ভয়, উত্তেজনা
* অনিয়মিত ও অপ্রতুল ঘুম
* স্লিপ অ্যাপনিয়া নামের শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা
* কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
* এমনকি বংশগত কারণেও হতে পারে এই সমস্যা
এককথায়, যখন মন ও শরীরের সংযোগে ছেদ পড়ে ঘুমের গভীরে, তখনই জন্ম নেয় এই নিঃশব্দ যাত্রা।
কীভাবে রোধ করা যায় এই রহস্যঘটনা?
প্রথমেই প্রয়োজন ‘সচেতনতা’ ও ‘সহানুভূতি’। স্লিপ ওয়াকিং কোনো অভিশাপ নয়, বরং একটি ঘুম-সম্পর্কিত সমস্যা, যার রয়েছে করণীয় ও প্রতিকার।
* আক্রান্ত ব্যক্তিকে একা ঘরে রাখা যাবে না। দরজা-জানালা নিরাপদ রাখতে হবে।
* স্লিপ ওয়াকিংয়ের সময় তাকে ধমক না দিয়ে ধীরে, স্নেহভরে বিছানায় ফিরিয়ে দিন।
* যদি নির্দিষ্ট ওষুধ থেকে সমস্যা হয়, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তা পরিবর্তন করতে হবে।
* স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যার সমাধান দিতে পারে।
* ধারালো বস্তু বা বিপজ্জনক কিছু ঘরে রাখা একেবারে নিষেধ।
* শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের ঘুমের সময় ও আচরণ লিখে রাখা যেতে পারে।
একটি কার্যকর কৌশল হচ্ছে—ঘুম ভাঙার আগাম প্রস্তুতি। স্লিপ ওয়াকিং শুরু হওয়ার ১০-১৫ মিনিট আগে জাগিয়ে দিন, ৫ মিনিট পর আবার ঘুম পাড়িয়ে দিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর অভ্যাসে পরিবর্তন আসতে পারে।
ভয়ের কিছু নেই, যত্নই মূল সমাধান
স্লিপ ওয়াকিং কোনো ভয়াবহ মানসিক রোগ নয়। বরং এটি এমন এক অবস্থা, যা ভালোবাসা, সচেতনতা আর একটু যত্নেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। হয়তো এমন একজন কাছের মানুষ আছেন, যিনি রাতের আঁধারে হাঁটছেন, নিঃশব্দে কাঁদছেন, অথচ জানেন না কিছুই। তাকে ভয় নয়, দরকার বোঝার—তার পাশে থাকা।
এই নিঃশব্দ যাত্রার গন্তব্য হোক আলোর দিকে, নিরাপত্তা আর সুস্থতার পথে।
What's Your Reaction?






