একটি পার্ক, কিছু পাঠক যেখানে শব্দেরা হাঁটে ঘাসের ভেতর: তরুণ হাতে পাবলিক স্পেসের নান্দনিকতা 

May 7, 2025 - 04:20
 0  1
একটি পার্ক, কিছু পাঠক যেখানে শব্দেরা হাঁটে ঘাসের ভেতর: তরুণ হাতে পাবলিক স্পেসের নান্দনিকতা 

ফিচার ডেস্ক, বিনা

ঢাকার ব্যস্ত, কংক্রিটের শহরে প্রাণ ফিরে পেয়েছে এক টুকরো সবুজ—বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ পার্ক। তবে এটি শুধুই একটি পার্ক নয়; এটি এখন পরিণত হয়েছে ঢাকার বাসিন্দাদের মিলনস্থলে—যেখানে বই, কফি, আলোচনার আসর আর শিশুর হাসিতে মুখর হয়ে ওঠে প্রতিটি সকাল-বিকেল।

এই রূপান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘বুকওয়ার্ম’—একটি স্বতন্ত্র বইয়ের দোকান, যা পার্কের আত্মাকে আরও গভীর করেছে।

এক বইপ্রেমীর স্বপ্ন থেকে শুরু

এই দোকানের গোড়াপত্তন করেছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস। যুদ্ধবিমান চালালেও তার হৃদয়ে ছিল বইয়ের প্রতি গভীর প্রেম। কলকাতার বইয়ের দোকান ঘুরে দেখা সেই প্রেম পরিণত হয় বুকওয়ার্মে। এখন এই বইয়ের দোকানটি পরিচালনা করছেন তার পুত্রবধূ ‘আমিনা রহমান’।

“প্রথম দিকে খুব কম মানুষ আসতেন,” বললেন আমিনা। “তখন সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে সচেতনতা গড়ার চেষ্টা করি, শুরু করি হোম ডেলিভারি। এখন পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন।”

শিশুর চোখে বইয়ের জাদু

ঢাকার একটি স্কুলের লাইব্রেরিয়ান ‘আদিবা মহসিন’ বললেন, “আমি প্রায় প্রতিদিনই বুকওয়ার্মে আসি। এখনকার শিশুদের বইগুলো এত চমৎকার—পপ-আপ, থিমেটিক, ইন্টারঅ্যাকটিভ, যা আমার সন্তানের শেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়।”

পার্ক পুনর্গঠনের পেছনের গল্প

এই রূপান্তর ছিল না কোনো কাকতালীয় ঘটনা। ২০২০ সালে ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন’ এবং ‘ফাইভআর সিকিউরেক্স কনসোর্টিয়াম’ মিলে নেন একটি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ—ঢাকার জনপরিসরগুলোকে পুনর্জীবিত করা।

এই কনসোর্টিয়ামের নেতৃত্বে ছিলেন ‘সিইও জুনাইদ রহমান’। পার্কটিকে নতুন জীবন দিতে গিয়ে তিনি শুধু প্রশাসনিক দক্ষতা নয়, হৃদয়ের আবেগও ঢেলে দিয়েছেন।

“আমাদের লক্ষ্য ছিল—একটি নিরাপদ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রাণবন্ত পার্ক তৈরি, যেখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজেকে খুঁজে পাবে,” বলেন জুনাইদ।

‘নর্থ এন্ড, গ্রাম চা ও চিন্তার জায়গা’

পার্কে বাড়তি কোনো বাণিজ্যিকীকরণ না করে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে 'নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স' ও 'গ্রাম চা'-এর মতো মনোমুগ্ধকর ক্যাফেগুলোকে—যেগুলো পার্কের শান্ত পরিবেশে মিশে যায়।

‘বুকওয়ার্ম: সংস্কৃতির মিলনমেলা’

এখন বুকওয়ার্ম শুধু বইয়ের দোকান নয়, বরং এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ‘ঢাকা সেশনস’-এর মতো ছোট্ট সংগীতানুষ্ঠান, ফিলিস্তিন ইস্যুতে আলোচনা সভা, শিশুদের বই পাঠ—সবই হয় এখানে।

লেখক ‘নাভিন মুর্শিদ’ বলেন, “এটা কেবল একটা পার্ক নয়, এটা এমন এক জায়গা—যেখানে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়, হেঁটে বেড়ানো যায়, পড়া যায়, ভাবা যায়।”

‘একটি ভবিষ্যতের রূপরেখা’

এই পার্ক এখন ঢাকাবাসীর জন্য শুধু একটি জায়গা নয়—একটি দৃষ্টান্ত। বিদেশি দর্শনার্থীরা পর্যন্ত বলেন, “এমন পরিসর প্রতিটি শহরের দরকার।”

তবে সামনে রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জও। জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় ও যানজট, বাণিজ্যিকীকরণের লোভ, পার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের আগ্রহ—সবই আশঙ্কার জায়গা।

“এই উদ্যোগ কমিউনিটির,” বলেন জুনাইদ, “লাভের নয়। পার্কের আত্মাকে রক্ষা করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow